মে মাসের প্রচণ্ড রোদের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে অম্লান তখন সবে পৌঁছেছে নিজের ডিপার্টমেন্ট। হাফপ্যান্ট আর আধঘেমো জামার ঘাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে শহুরে দামি ডিওর আবেশকে। কোনোরকমে এসিতে ঢুকলে বাঁচে। হন্তদন্ত হয়ে বসতে যাবে নিজের ডেস্কে, হটাৎ চোখ টানলো টেবিলে রাখা একটা কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে। কে রাখলো এটা! ল্যাবের কেউ তো এমন করে না হুটহাট করে। খুব সন্দেহ আর একটা চাপা আনন্দ নিয়ে খুব সাবধানে সরিয়ে রাখলো ফুলটা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার চোখ পড়ছিলো টেবিলের পাশে রাখা সেই ফুলটার উপর। কাজের চাপে বিকেল গড়ায়, রাত্রি হয়, এবার ঘরে ফিরে যায় অম্লান। রাতে সোয়ার সময় বারবার মাথায় আসছে সেই ফুলের কথা। কে ই বা এমন করতে পারে! যাগগে, এতো ভেবে কাজ নেই। কেউ ভুল করে রেখে গেছে হয়তো।
পরের দিন ঠিক আগের মতই হাজির হয় ডিপার্টমেন্ট। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে নিচে রাখতে যাবে কি ঠিক সেইখানেই আবার নতুন একটা কৃষ্ণচূড়ার ফুল। এবার সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট। খুব অবাক হয়েই চিরকুট খুলে দেখলো অম্লান। একটা ছোট্ট কবিতা লেখা...
কিছু শব্দ এথা গোপন থাকে,
কিছু ইচ্ছে থাকে চাপা,
আজ রোদ পোড়া এই কপাল জুড়ে
কৃষ্ণচূড়ার ফুলে, ভালোবাসা আঁকা।
অম্লানের জীবনে এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা। ওর জন্য কেউ কবিতা লিখবে এটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। তবে সত্যিই কি ওর জন্য! নাকি! না, এতোটা ভুল কি হবে কারোর। লোকভরতি ল্যাবে খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখলো লেখাটা। এবার ফুলটাও সাথে নিয়ে গেলো। এককামরার হোস্টেল রুম জুড়ে সেদিন এক চাপা আনন্দ আর অনেকগুলো প্রশ্ন। যার জবাব হয়তো পাবে কিনা জানেনা। চেনা পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধব, সকলের মুখ ভাবতে ভাবতে কিছুতেই তাল খুঁজে পাচ্ছিলো না! এ যেন এক কারোর গোপন স্বীকারোক্তি। যাকে ছুঁয়ে যাওয়া যায়, তবু তা ধরা দেয় না। যার আবেশ ঠিক কালবৈশাখীর বৃষ্টির আগের ঝড়ের মতো। যা সবটা ছুঁয়ে, গর্জিয়ে চলে যায়, বৃষ্টি আর নামে না।
এক অমোঘ আনন্দে, অম্লান, অপেক্ষায় থাকে রোজ। রোজ একটি ফুলের সাথে একটি ছোট্ট লেখা। খুব সযত্নে সামলে রাখে তা।
এক অজানা এক সময় পাড়ি
মনের নদী বেয়ে,
ধরা দেওয়া মোহনাতেই
সাগর পানে চেয়ে।।
ঋদ্ধ হেথায় অপেক্ষাসই
প্রহর গোনা ক্ষন,
কাব্য ছেড়ে চিরকুটেতেই
আটকে পড়া মন।
এভাবেই একটার পর একটা কবিতা জমা হতে থাকে অম্লানের কাছে। খুব সামলে দিনক্ষণ লিখে সাজিয়ে রাখছে সে সবটা। তবু সে মানুষের ধরা পাওয়া যাচ্ছে না। তবু সেই অপেক্ষাটাই যেন একটা রোজকার ইচ্ছে, কোনো সুদূর ইচ্ছেপূরণের জন্য। কয়েকদিন পরে আগের মতোই একটা চিরকুটে লেখা কবিতা পড়ে মনটা উদাস হয়ে গেলো অম্লানের।
এই কয়েকদিন চুপশয়তানি
অনেক দূরে পাড়ি,
দেখা হবে অতলান্তে,
ফিরলে, সাগরপাড়ে বাড়ি।।
ব্যাস, এবার কয়েকদিন চিঠি, ফুল সব পাওয়া বন্ধ। বেশ মনখারাপের সুরেই বাড়ি ফিরলো অম্লান। নিজের ঘরে একা একা বসে কাটল অনেকক্ষণ। অগত্যা, মেনে নেওয়াই সমীচীন। তাই আবার নিজের কাজে মন বসালো সে। তবু মন কি বসে! প্রতিদিনের যাওয়ার আসার ফাঁকে খুঁজে চলেছে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত পরের চিরকুট। দুদিন যায়, চারদিন যায়, খুব অস্থির হয়ে উঠতে থাকে সে।
......।
দিনটা সেদিন শনিবার। সকালেই উঠেই চারিদিকে সবার মুখে মুখে শুধু এক ট্রেন দূর্ঘটনার খবর। ওড়িষার বালেস্বরের কাছে ভয়াবহ এক দূর্ঘটনা। ইউটিউব, ফেসবুক খুলে স্ক্রল করে দেখতে থাকে সেইসব ভায়াবহ সব ছবি। খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা সকলে। সেখানে বোধহয় এই ছোট্ট চিরকুট আর এই ছোটোছোটো ভালোলাগার আবেশই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের। পুরোনো চিরকুটের কথা আর এদিক ওদিক ভাবতে ভাবতে, অম্লানের চোখ গেলো ফেসবুকে থাকা একটা ছবিতে। ধ্বংসস্তুপের মতো পড়ে থাকা ট্রেনের অংশগুলোর মাঝে কোনো প্রেমিক বা প্রেমিকার ডাইরি। পাতায় ভর্তি লেখা বোধহয় প্রেমের সেই শেষের কবিতা। একটু কাছে নিয়ে জুম করে কবিতাটা পড়তে গিয়ে অম্লানের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। এতো চিরকুটে লেখা সেই কবিতার হুবহু একই কবিতা। এসি রুমের ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠছিলো অম্লান। কি করবে, কাকে বলবে, এসব কিছু বুঝতে না পেরে সোজা ফিরে আসে রুমে। পাগলের মতো ফেসবুক, খবর দেখতে থাকে। তবু সেই ডাইরির খোঁজ আর মেলেনি। বিকেলের সূর্যাস্তের সাথে সাথে অম্লানের চোখের জল ভিজিয়ে তুলছিলো চিরকুটের কবিতাকে।
![](https://static.wixstatic.com/media/28e828_aa24608e87bc4b2da28f232ce4ba9ce5~mv2.jpg/v1/fill/w_980,h_558,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_avif,quality_auto/28e828_aa24608e87bc4b2da28f232ce4ba9ce5~mv2.jpg)
......।
এখন কয়েকমাস গেছে কেটে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সরে গেছে কত সময়। হয়ত সকলে ভুলেও গেছে সেই ঘটনার কথা। কিছুজনের ছন্দে ফিরেছে জীবন। কিছুজন সামলে নিয়েছে নিজেকে সন্তর্পণে। সকালের আড়মোড়া ভেঙে হালকা আলোতে বাগানে বেরিয়েছে অম্লান। এ তার এখনকার রোজনামচা। রুমে এসে এবার চললো কাজের জন্য, ল্যাবে। টেবিলের উপর তখন বাগান থেকে আনা একটা কৃষ্ণচূড়ার ফুল সযত্নে রাখা। আর তার পাশে একটা চিরকুট আর কলম।
চলতি জীবন সবাই গড়ি,
গড্ডলিকার ধাঁচে,
কিছু শব্দ তবু গোপন হয়ে
অপেক্ষাতেই বাঁচে।
![](https://static.wixstatic.com/media/28e828_33a847871b59451f96b84495b8c72296~mv2.jpg/v1/fill/w_980,h_735,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_avif,quality_auto/28e828_33a847871b59451f96b84495b8c72296~mv2.jpg)
লেখা- শুভঙ্কর
ছবি- শুভঙ্কর এবং এবিপি আনন্দ
গল্পের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক।
Comentarios